দৃষ্টিভঙ্গি
**কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য**
অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যে কোন ধরনের সঙ্কটকালীন সময়ে প্রত্যেকের মধ্যে থাকা সাংস্কৃতিক বিশ্বাসগুলো আরো বেশি প্রকাশিত ও প্রকট হয়ে উঠে। ফলে প্রচলিত ধ্যান ধারণার বশবর্তী হয়ে মানুষ এমন ধরনের আচরণ করতে পারে যার ফলে প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক/প্রবীণদের পক্ষে জরুরি স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য সেবা পাওয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য সঙ্কটের সময়ে এমন ধারণা ও বিশ্বাসের বিস্তৃতি ঘটেছিল যে কিছু মানুষের সক্ষমতা অন্যদের চেয়ে বেশি, যার ফলে নীতি প্রণয়নে বিলম্ব হয়েছে এবং তাদের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করা হয়েছে।
এ কারণে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার একদম শুরুতেই কিংবা যতোটা সম্ভব দ্রুততার সাথে টুইন-ট্র্যাক পদ্ধতি অবলম্বন/গ্রহণ করতে হবে এবং যোগাযোগ ও তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে।
*********************
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি এখনো অনেক দেশেই প্রায়শই নেতিবাচক এবং প্রতিকূল। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রায়শই অপবাদের শিকার হয় এবং তাদের সক্ষমতা ও সামর্থ্য বিষয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি মূলত প্রচলিত ধ্যান ধারণার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে মনো-সামাজিক প্রতিবন্ধিতার ক্ষেত্রে মানুষের ধারণা গতানুগতিক। আর এসব কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যাপারে এক ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করতে দেখা যায় কিংবা তাদের সুরক্ষার ব্যাপারে অতিমাত্রায় সচেতন হতে দেখা যায়। এসব কারণে দেখা যায় যখন দুর্যোগ কিংবা জরুরি পরিস্থিতির মতো ঘটনা ঘটে তখন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে দুর্ব্যবহার করা হয় এবং তাদেরকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করা হয়।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শনের মাধ্যমে নেতিবাচক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করাটাই হলো সর্বোত্তম পন্থা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করুন এবং এটা প্রত্যাশিত যে অন্যরাও তাই করবে। উদাহরণস্বরূপ, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তাদের দৈনন্দিন জীবনে সত্যিকারের পছন্দ করে বাছাই করার সুযোগ দেওয়া হলে তাদেরকে নিয়ে যে অনুমানগুলো সমাজে বিরাজমান একদিকে সেগুলোকে যেমন চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয়, অন্যদিকে তাদের সাথে যে আচরণ করা হয় তাতে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে।
অতএব জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সম্পৃক্ত প্রতিটি মানবিক কর্মীর জন্য একটি শ্রদ্ধাপূর্ণ ও ইতিবাচক মনোভাব অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক এবং প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে একটি সাধারণ শিষ্টাচার অবশ্যই অনুসরণ করা উচিত্:
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরনের সহায়তার প্রয়োজন হয় এবং তারা কীভাবে সহায়তা পেতে চান তা নিয়েও তাদের পছন্দ আছে। বেশিরভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি স্বাধীনভাবে বসবাস করেন এবং তাদের সাহায্যের দরকার হয় না। বাকিদের সহায়তা নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে দেখা মাত্র এমনটা অনুমান করা ঠিক নয় যে তার সাহায্য লাগবেই, বরং অন্যদের সহায়তা করার ক্ষেত্রে আমাদের যে মানসিক প্রস্তুতি থাকে তাদের বেলায়ও সেই ধরনের মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে যাতে করে প্রয়োজনের সময় সাহায্য করা যায়;
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং যে ব্যক্তি তাকে সহায়তা করতে পারে কিংবা দোষাভীর সাথে সরাসরি কথা বলুন। একই ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া পূর্ব-অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আরেকজন সম্পর্কে কিংবা তার প্রতিবন্ধিতার মাত্রা সম্পর্কে কিংবা তার চাহিদা বা পছন্দের ব্যাপারে অনুমান করবেন না। সবসময় মনে রাখতে হবে প্রতিটি মানুষই ভিন্ন ও স্বতন্ত্র!
- আপনি যখন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী কিংবা শারীরিক উচ্চতার দিক থেকে খর্বাকৃতির কারো সাথে কথা বলবেন তখন আপনার নিজেকে তার চোখের স্তরে নামিয়ে এনে কথা বলুন;
- আপনি যখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কিংবা অন্ধ কারো সাথে কথা বলবেন তাকে আপনার পরিচয় দিন এবং আপনি যখন চলে যাবেন তখন তাকে আপনার চলে যাওয়ার কথাটি জানাতে ভুলবেন না। জায়গা সম্পর্কে ধারণা দিন এবং মুদ্রিত তথ্য কিংবা যেখানে অডিও বর্ণনা নেই যেমন ভিডিও, ভূমিকা অভিনয় কিংবা চিত্রের বর্ণনা দিন। মেঝেতে কোন ধরনের বস্তু ফেলে রেখে চলে যাবেন না তাতে চলাচলে বাধা তৈরি হতে পারে কিংবা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
- যাদের কথা বলতে সমস্যা হয় এমন ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গকে তার বক্তব্য পুনরায় বলতে বলুন, তাতে করে ওই ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গ একসময় মতামত প্রকাশে সাবলীল হবে এবং আপনি যে তার বা তাদের মতামত বা বক্তব্যকে গুরুত্ব দেন এই জন্য তারা আপনার প্রশংসা করবে এবং আপনার সাথে তাদের একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠবে;
- শ্রবণ প্রতিবন্ধী কিংবা শ্রবণে সমস্যাযুক্ত ব্যক্তিদের সাথে কথা বলার সময় সামনে থেকে বা পাশ থেকে কথা বলুন যাতে করে আপনার কণ্ঠস্বর তাদেরকে আতঙ্কিত না করে। তাদের পছন্দের যোগাযোগ মাধ্যম সম্পর্কে তাদের কাছ থেকে জেনে নিন; যেমন তারা কি ইশারা ভাষা পছন্দ করে নাকি ঠোঁট নাড়িয়ে বলা (লিপ রিডিং) পছন্দ করে। আপনি যখন বধির কারো সাথে কথা বলবেন তখন অবশ্যই তাদের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলবেন এবং যা বলবেন স্পষ্টভাবে বলবেন। আপনার মুখের সামনে বা ঠোঁটের সামনে কোন কিছু রাখবেন না। কথা বলার সময় আপনার মুখের মুখের যাতে আলো পড়ে সেটা নিশ্চিত করুন। এবং এমন কোন অঙ্গভঙ্গি করবেন না যা আপনার বক্তব্যের সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিংবা ভুল বার্তা দেয়। পর্যাপ্ত আলো যেন থাকে তা নিশ্চিত করুন। যাতে করে বধির ব্যক্তি যেন আপনার ঠোঁট নড়া দেখতে পায়, বুঝতে পারে, আপনার নড়াচড়া ও অঙ্গভঙ্গি দেখতে পায়। আপনি যদি ইশারা ভাষা ব্যবহার করেন তাহলে আপনার বক্তব্যকে ইশারা ভাষায় প্রকাশ করার জন্যে দোভাষীকে পর্যাপ্ত সময় দিন। মনে রাখুন যে, কোন কোন সংস্কৃতিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য হাত নাড়া কিংবা স্পর্শ করাকে অসভ্যতা হিসেবে দেখা হয়।
- আপনি যখন শিখন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করবেন তখন যা বলবেন সুস্পষ্টভাবে বলবেন এবং ছোট ছোট বাক্য বলুন। প্রয়োজনে একই কথার পুনরাবৃত্তি করুন কিংবা কথাটাকে বুঝিয়ে বলুন। কারণ মূল বিষয়টি হলো তাদেরকে বোঝানো বা বোঝাতে পারা। স্বাভাবিকভাবে কথা বলুন। কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখুন। শিশুসুলভ কণ্ঠ কিংবা অতিরঞ্জিত করে কথা বলবেন না।
- হুট করে কাউকে ব্যক্তিগত বা আক্রমণাত্মক কোন কিছু বলা থেকে সবসময় বিরত থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কথা নাই বার্তা নাই হুট করে বলা যাবে না: 'আপনার কী হয়েছে — আপনি কেন ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না?' আরো মনে রাখুন যে আপনাকে অনুরোধ করা না হলে আপনি নিজে থেকে কারো হুইলচেয়ার কিংবা সাদা ছড়ি কিংবা এমন অন্য কিছু যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ব্যবহার্য বা প্রয়োজনীয় উপকরণ সেগুলো ধরবেন না বা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরাবেন না।
সোলের (SOLER) মডেল যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ব্যবহৃত অ-মৌখিক যোগাযোগ মডেল, সেটি আপনার নিজের অবস্থান তৈরির জন্য একটি অনুপ্রেরণামূলক হতে পারে (নিচের সূত্র দেখুন)।
পরিশেষে, আপনি যদি কীভাবে আচরণ করবেন কিংবা কোন ভাষা ব্যবহার করবেন, সেটা নিয়ে চিন্তিত হন, তাহলে সহজ বুদ্ধি হলো —অতো না ভেবে সোজা জিজ্ঞাসা করুন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তাদের মর্যাদা, পছন্দ ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রতার জন্য সত্যিকারের সততা ও সম্মান পছন্দ করবে।